দেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। পরস্পরবিরোধী এ দুই দলের রাজনীতি দুই মেরুর। এ দুই মেরুরই এতদিন ধরে চলে আসা হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতির ভাষা কূটনৈতিক ও পরিধি ব্যাপক। এটি পরিশীলিত ভাষায় প্রচ্ছন্ন ‘হুঁশিয়ারি’। এর তাৎপর্য অত্যন্ত নিগূঢ় ও দ্ব্যর্থহীন। এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।
এ ভিসানীতি শুধু আমেরিকার মনে করলে ভুল হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত হলেও এতে রয়েছে জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, ব্রিটেন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া সরকারের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিহত প্রভাব ও শক্তিমত্তা। মার্কিন নীতি বা নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো অনুসরণ করে থাকে। এ নীতির ফলে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল সুশীলসমাজের যে অংশ রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করেন,তাদের রাজনৈতিক ব্যাখ্যার পরিবর্তন আসতে পারে। গুম,গায়েবি মামলা, ভয়ের সংস্কৃতি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হ্রাস পেতে পারে। কোয়াডে যুক্ত হওয়ার ও ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সমঝোতা স্বাক্ষরে বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে।
নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক ধারা তৈরি করতে পারে। উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতা, আমলা, বিচারক, সেনা কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদস্যের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি রয়েছে। অনেকের ছেলেমেয়ে সেখানে চাকরি, ব্যবসায় বা পড়ালেখা করছেন। বাইডেন সরকার বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে মনে করে না। যদি করত তাহলে ২০২১ ও ২০২৩ সালে গ্লোবাল ডেমোক্র্যাসি সামিটে ঢাকা আমন্ত্রিত হতো। কর্তৃত্ববাদী সরকারকে প্রতিহত করা, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা- এ তিন লক্ষ্যে অঙ্গীকার পূরণের অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে সম্মেলনে আলোচনা হয়।
২০২১ সালের সম্মেলনে ১১০টি দেশের প্রায় ৭৫০ প্রতিনিধি অংশ গ্রহন করেন। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ২০২৩ সালের গণতন্ত্র সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সহআয়োজক হিসেবে ছিল কোস্টারিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস ও জাম্বিয়া। সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপসহ বিশ্বের ১১১টি দেশ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি।
বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন যে, ভিসানীতির পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্খা কাজ করেছে, নাকি এর পেছনে আরো কোনো গভীর ‘কৌশলগত’ হিসাব-নিকাশও আছে? ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ থাকাও বিচিত্র নয়। অতীত ঘটনাপ্রবাহ মনে করিয়ে দেয়, কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমে থাকে নিজের স্বার্থের প্রাধান্য।
ভিসানীতির বিষয়টি ২৩ মে রাতে ঘোষণা করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে সিদ্ধান্তটির কথা জানিয়ে দেয়। এর পরপর সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ৪ মে লন্ডনে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন। ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় দেশের রাষ্ট্রদূতের পুলিশ এসকর্ট-সুবিধা বাতিল করা হয়। ১৫ মে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘যারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু কিনব না। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’ বাংলাদেশের জনগণ ভোটের অধিকার ফিরে পেতে উন্মুখ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শেকড় মজবুত না হলে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আসে না। ভিসানীতিকে গভীর বিচেনায় না নিলে এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটলে নাইজেরিয়া ও উগান্ডার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মার্কিন চাপে যদি বাংলাদেশ রাশিয়া ও চীন বলয়ে ঢুকে পড়ে সেটি আরো বিপদ ডেকে আনতে পারে।
চীনের সাথে ভারতের বৈরিতা পুরনো। ভারতের সাথে আমেরিকার সমঝোতা ভালো। মার্কিন সরকার ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে। ছয় মাস পরপর পর্যালোচনা করার কথা থাকলেও স্থগিত আদেশ আজ অবধি প্রত্যাহার করা হয়নি। বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে আমেরিকার হাতে অনেক ঘুঁটি এখনো অবশিষ্ট আছে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাপ্রার্থীদের নির্দিষ্ট ফরমে নির্বাচনবিষয়ক বেশ কিছু তথ্য প্রদানের (ক্ষেত্রবিশেষে) বিষয়টি সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ কোনো ছোট দেশ নয়। প্রায় ১৬ থেকে ১৮ কোটি জনসংখ্যার ১০ কোটি ভোটার, যা হয়তো ইউরোপের মোট জনসংখ্যার কাছাকাছি হতে পারে। কাজেই এমন দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় না থাকলে এই অঞ্চল তথা গণতান্ত্রিক বিশে^র জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হতে পারে। এমনিতে বিশে^ উদার গণতন্ত্রের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে। বিষয়টি বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ^ যাদের সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বিশেষ করে বিগত দুই বছরের ইউরোপে যুদ্ধের মাধ্যমে এমন ভাবনার জন্ম দেয়ার কারণে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ তৎপরতা আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলছে বলে ধরে নিয়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ হুমকি ঘুম হারাম করেছে বিরোধীদের।
একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষই প্রচার করছে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নয় তারা। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর দাবি- ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনসহ বর্তমান সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই নির্বাচনের প্রায় ৭ মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে। মার্কিন এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। তবে এই বিষয়ে আলোচনায় রয়েছেন আরও এক ব্যক্তি। তিনি হলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সেই ডোনাল্ড লুও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেছেন- নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা করলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাও মার্কিন ভিসা পাবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনে ‘অনিয়ম’ করার দায়ে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে- নাইজেরিয়া, উগান্ডা, বেলারুশ, নিকারাগুয়া, সোমালিয়া। আর বিএনপির নেতারা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করার দায়িত্ব যেহেতু সরকারের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি নিয়ে বিরোধী দলগুলোর চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন করার ৯০ শতাংশ দায় সরকারের। বিরোধী দলগুলো শুধু সহযোগিতা করতে পারে। আর এই সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও সমাধানযোগ্য পথ হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে- ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের ভাষায়- ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমসহ সবার। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সকলকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি মূলত আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু মুশকিল হলো এ বিষয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর শিরোনাম নিয়ে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা বলছেন, এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। সুতরাং সে হিসেবে ধরলে, কিছু শিরোনাম যারা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরোধীতা করছেন সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে যায়। যেমন, ‘অবাধ নির্বাচনে বাধা এলে জড়িতদের ভিসা বন্ধ’। আরেকটি হলো, ‘ব্লিনকেনের টুইটবার্তা- যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পলিসি, নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা নয়’। এ দুটি শিরোনাম পর্যালোচনা করে কী মনে হয়? সরকার কি নির্বাচনে বাধা দিবে? নিশ্চয়ই নয়। তারা তো চাচ্ছে নির্বাচনটাকে পার করে নিতে। সে যেভাবেই হোক। বাধা দিলে দেবে বিরোধীরা। সুতরাং এই শিরোনাম নিশ্চিত সরকার বিরোধী নয় বরং সরকার বিরোধীদের বিরোধী। অনেকটা উল্টো বুঝলি রামের মতন অবস্থা।
সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর একটি অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি দেশ, জাতি, জনগণ এবং সরকারকে একটি ভালো ইলেকশনের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন অনেকে। যার উদাহরণ হিসেবে ভিসা নীতি ঘোষণার পরপরই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক টেবিলে বসার ঘটনাকে তুলে ধরা হচ্ছে। কারণ, নির্বাচন সামনে রেখে সংকট সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের কথা বলা হলেও এ ঘটনার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় বসেননি; যদিও ভেতরে ভেতরে আলোচনা চলছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে। মার্কিন ভিসা নীতি যে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে, সেটা এই তিন দলকে অবহিত করেন রাষ্ট্রদূত। একই সঙ্গে কোন প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট নিরসনের উপায় কী হতে পারে, দলগুলোকে সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ডায়ালগের মাধ্যমে যে সংকট সমাধানের পক্ষে, সেটাও জানান পিটার হাস।
তবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা স্ব-উদ্যোগে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে পারতেন, সেটা সম্মানজনক হতো। কিন্তু বাংলাদেশের সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশে আলাপ-আলোচনার সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিভাজনের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল সহজ নয়। তাই এখানে যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়েই হঠাৎ ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন- বিষয়টি এমন সহজ নয়।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply