সাংবাদিক হত্যা করলে কার কী যায় আসে! কিছু বিবৃতি, মানববন্ধন, ক্ষুব্ধ মতপ্রকাশের পর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। একজন সাংবাদিক খুন মানে যে জনগণেরই কণ্ঠরোধ সেই উপলব্ধি আমাদের নেই। ইউনেসকোর প্রথম নারী মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা বলেছেন, সব হত্যাই বেদনাদায়ক, কিন্তু যখন কোনো সাংবাদিকের মৃত্যু হয়, তখন জনগণ তার পক্ষে কথা বলার একটি কণ্ঠস্বর হারায়। তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রতিকার চাওয়ার মতো সরকারি কোনো ব্যবস্থা নেই। নিপীড়নের শিকার হলে তাদের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে যেতে হবে। সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন,‘পাকিস্তানের মতো দেশে দুটি প্রভিন্সে জার্নালিস্ট প্রোটেকশন ল আছে, যেটা আমাদের দেশে নেই। এটা অত্যন্ত লজ্জার। এ ধরনের আইন থাকা খুবই দরকার। বরং (বাংলাদেশে) সাংবাদিক নির্যাতন করার আইন প্রচুর আছে, কিন্তু সাংবাদিককে রক্ষা করার কোনো আইন নেই।’ সাংবাদিকদের বর্তমান অবস্থা হলো হাত-পা বেঁধে কুমিরভর্তী পুকুরে ফেলে দেয়ার মতো।
জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর (১৮ জুন-২৩) পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সঙ্গে আরও ১৩ আসামির বিরুদ্ধে পুলিশের রিমান্ড মঞ্জুর করেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর আহমেদ।
১৪ জুন রাত ১০টার দিকে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে বকশীগঞ্জ পৌর শহরের কলেজ মোড়ে বাবু ও তার সহযোগীরা নাদিমের ওপর হামলা চালায়। বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এই ঘটনায় নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বাদী হয়ে বাবু চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে বকশীগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
দেশে গত সাড়ে সাত বছরে পেশাগত দায়িত্ব পালনে ৯ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। একই সময়ে শারীরিক নির্যাতন, মামলা, হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন ১৪০০ সাংবাদিক। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। আসকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে ১ জন, ২০১৮ সালে ২ জন, ২০১৯ সালে ১ জন, ২০২০ সালে ১ জন, ২০২১ সালে ১ জন, ২০২২ সালে ১ জন নিহত হন। সর্বশেষ ১৫ জুন-২০২৩ এ সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম কে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
১৯৯৬ সালে কামরুজ্জামানকে নীলফামারীতে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনিকে তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন করা হয়। ১১ বছরের বেশি সময় পার হলেও আলোচিত এই হত্যার বিচারের দাবিতে এখনো আন্দোলন ও কর্মসূচি পালন করেন সাংবাদিকরা। ইতিমধ্যে এ হত্যা মামলার প্রতিবেদন দিতে গত ২২ মে পর্যন্ত ৯৭ বারের মতো সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা র্যাব। এই ঘটনার আগে-পরেও সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। কিন্তু গত দুই দশকে বিচারে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে এমন ঘটনার নজির নেই।
২০০০ সালের ১৬ জুলাই রাতে যশোরে গুলি করে হত্যা করা হয় দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক শামছুর রহমানকে। দুইবার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেয়ার পর ২০০৫ সালের জুন মাসে অভিযোগ গঠন করা হয়। কিন্তু আসামিপক্ষ মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে আবেদন করে হাইকোর্টে। এই আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় এ মামলার বিচারকাজ প্রায় ২৩ বছর ধরে বন্ধ। ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট খুন হন যশোরের দৈনিক রানার পত্রিকার সম্পাদক আর এম সাইফুল আলম মুকুল। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে ২২ জনকে অভিযুক্ত করে যশোরের সংশ্লিষ্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে মামলাটি স্থগিত হয়ে যায়।
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে বোমা হামলায় নিহত হন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক মানিক সাহা। প্রায় ১৩ বছর পর বিচারিক আদালতে এ হত্যা মামলার রায় আসে। মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। ২০০৪ সালের ২৭ জুন খুলনার শান্তিধাম এলাকায় সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক ‘জন্মভূমি’ পত্রিকার সম্পাদক ও খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি হুমায়ুন কবির বালু। ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রধান গৌতম দাস হত্যা মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রæয়ারি সিরাজগঞ্জে শাহজাদপুর এলাকায় সংঘর্ষের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনরত আব্দুল হাকিম শিমুল শটগানের গুলিতে নিহত হন। এ মামলার বিচারকাজ এখনো শুরু হয়নি।
২০১২ সালের ১৫ জুন যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক গ্রামের কাগজের সাংবাদিক জামাল উদ্দীনকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাভারের ধামরাইয়ে বিজয় টেলিভিশনের ধামরাই উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক জুলহাস হত্যাকান্ডের শিকার হন। ২০০১ সালে খুলনার ‘দৈনিক অনির্বাণ’ পত্রিকার সাংবাদিক এস এম নহর আলী হত্যা, ২০০২ সালে খুলনার ‘দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হারুনার রশীদ খোকন হত্যার বিচার মেলেনি আজও। ২০১৪ সালের ২১ মে খুন হন নিপুল। চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার এ সাংবাদিককে হত্যার পর তার দেহ ১০ টুকরা করা হয়। সাংবাদিক হত্যাকান্ডের কোনোটার বিচারই শুরু হয় না, কোনোটা চার্জশিটে আবদ্ধ, কোনোটা আবার তথ্য-প্রমাণের অভাবে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে আটকে যায়। গত বছরের ফেব্রæয়ারিতেও হত্যাকান্ডের শিকার হন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। সম্প্রতি হাতিরঝিলে সাংবাদিক হাবীবুর রহমানের মৃত্যুও নানা মহল থেকে তদন্তের দাবি উঠছে। বিচারহীনতার সুযোগে, সাংবাদিক হত্যার এমন মনস্তত্ত¡ একদিনেই গড়ে ওঠেনি। শুরুটা হয়েছিল, অনেক আগে। যার তালিকা দীর্ঘ। তবে ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জন সাংবাদিককে। সাগর-রুনি, শহীদ আনোয়ার, ফরহাদ খাঁ ছাড়া বাকি সবাই মফস্বলের সাংবাদিক।
সময়ের আবর্তনে এখন একজন সাংবাদিককে হত্যা করা মামুলি বিষয়। প্রকৃত সংবাদ প্রকাশের ফলে কী হতে পারে, তা জানেন সেই সাংবাদিক। তবু তিনি করেন। ঠিক যেন সংশপ্তক! তিনি জানেন, পরাজিত হতে পারেন। তবু হাল ছাড়েন না। তাই এইসব খুনীদের দ্রæত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে না পারলে, আরেকজন সাংবাদিক আক্রান্ত হবেন দ্রæত। ফলে, সাংবাদিকের মনে চূড়ান্তভাবে বাসা বাঁধবে এক ধরনের আতঙ্ক। দেশের মানুষ বঞ্চিত হবেন সঠিক এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে। কোনো অপরাধের সংবাদ প্রকাশিত হবে না। চিহ্নিত হবেন না অপরাধী। অপরাধের নটরাজ নিয়ন্ত্রণ করবে সব। নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাবে দেশ। কোনো গণমাধ্যমেই থাকবে না অপরাধ-অন্যায়ের বর্ণনা। অবাধ তথ্যপ্রবাহ শুধু লেখা থাকবে পুস্তকের পাতায়।
আসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছে। সংকুচিত গণতন্ত্র আর প্রশ্নবিদ্ধ জনপ্রতিনিধিত্বের কারণে রাজনীতিতে এখন দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে। আর তাদের নেতিবাচক এই দিকটির প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটছে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দুই-একটি ছাড়া গত ৫০ বছরে দেশে কোনো সাংবাদিক হত্যার চূড়ান্ত বিচার হয়নি। এটির কারণ হতে পারে হয়তো এ বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় না। আর যারা সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনে অভিযুক্ত তারা সবসরকারের আমলেই প্রভাবশালী এবং সরকারি মদদপুষ্ট লোক। তারা ক্ষমতার শক্তিতে বলীয়ান হয়েই এসব করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব ঘটনায় বিচারের জন্য এখন আর শুধু সাংবাদিক সমাজের দাবি তুললেই হবে না, যে সমাজের জন্য সাংবাদিকরা কাজ করেন সেই সমাজ ও নাগরিক প্রতিনিধিদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
বøাস্টের ট্রাস্টি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, ‘অনেকটা নীতিবিহীন রাজনীতি চলছে। যে কেনো উপায়ে অর্থবিত্ত পদ-পদবি পেতে একটা শ্রেণি উদগ্রীব এবং এজন্য তারা যে কোনো দুষ্কর্ম করতেও তৎপর। আর এটি যখন গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রকাশ পায় তখনই তারা সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন ও অত্যাচার শুরু করেন। হত্যা করতেও দ্বিধা করেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে সরকারপক্ষ বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বিচার তো হয়ই না, ন্যায়বিচার তো দূরের কথা। কেন বিচার পেতে এত অপেক্ষা করতে হবে? বিচার ছাড়া কোনো কিছুতে শান্তি আসে না এই সত্যটি সংশ্লিষ্টদের উপলব্ধি করতে হবে।’
‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’ বলে প্রচলিত এ শব্দবন্ধ এ ক্ষেত্রে যথার্থই প্রযোজ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের দীর্ঘসূত্রতা, জটিল বিচারিক প্রক্রিয়া, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাবসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আইনগুলোয় সাংবাদিকদের সুরক্ষার কথা সেভাবে বলা নেই। এ কারণে তারা দ্রæত বিচার পান না। ফলে সাংবাদিক নির্যাতনও বন্ধ হয় না।
গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব পালন করেন। সমাজে ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ যেখানে দুর্নীতি, টাকা পাচার, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যসহ নানা অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত, সেখানে বাস্তবিক অর্থেই দেশকে সঠিক পথে চালনায় সর্বদা সজাগ থাকেন এ গণমাধ্যমকর্মীরাই।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি- ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply