জুন মাসে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ করেছেন ৬১ কোটি টাকা। ভ্রমণ, চিকিৎসা ও অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা করতে এই টাকা খরচ হয়। ঐ মাসে মোট খরচ হয়েছে ৩৮৮ কোটি টাকা। ভারতে খরচ হয়েছে মোট খরচের ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী বছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার খরচ করতে পারেন। বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের খরচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ শতাংশ, সৌদি আরবে ৮ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৭ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৬ শতাংশ, কানাডায় ৬ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও নেদারল্যান্ডসে ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশিরা যেমন ভারত বা অন্য দেশে গিয়ে টাকা খরচ করেন তেমনি বিদেশিরা বাংলাদেশে এসে অর্থ খরচ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুনে বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন ১৯৬ কোটি টাকা, যা মে মাসে ছিল ২১০ কোটি টাকা। এক মাসে বিদেশিদের লেনদেন কমেছে ৭ শতাংশ। বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডধারীরা জুন মাসে বিদেশে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন, একই সময়ে বিদেশিরা বাংলাদেশে এসে খরচ করেছেন তার অর্ধেক । বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের ভেতরে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মোট খরচ হয়েছে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা, যা আগের মাসের চেয়ে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। আগের মাসে খরচ হয়েছিল ২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা।
ক্রেডিট কার্ডধারীদের ব্যয়ের প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতেই ক্রেডিট কার্ড বেশি ব্যবহার হয়েছে। জুনে ক্রেডিট কার্ডের মোট খরচের প্রায় ৪৬ শতাংশ খরচ হয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে। ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এক্ষেত্রে। ১৩ শতাংশ খরচ হয়েছে ফান্ড ট্রান্সফারে। এছাড়া কার্ডধারীরা বিভিন্ন রিটেইল আউটলেট, নগদ উত্তোলন, পোশাক কেনাকাটা, ওষুধ ও ফার্মেসি, পরিবহন এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কার্ড ব্যবহার করেছেন। প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুনে বিদেশের সুপারশপে বাংলাদেশিরা ১৫৭ কোটি টাকার কেনাকাটা করেছেন। তারা ওষুধ কিনেছেন ৬১ কোটি টাকার, কাপড় কিনেছেন ৪৬ কোটি টাকার ও যাতায়াতে ব্যয় করেছেন ২৯ কোটি টাকা। ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য খাতগুলোর মধ্যে আরও আছে নগদ টাকা উত্তোলন, ব্যবসা সেবা, পেশাগত সেবা ও সরকারি সেবা গ্রহণের মতো খাত। লেনদেনে কার্ডের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিসা কার্ডের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে। এর পরিমাণ ৭৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এরপরই রয়েছে মাস্টার কার্ড। এ কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাকি প্রায় ৯ শতাংশ লেনদেন হয়েছে অন্যান্য কার্ডের মাধ্যমে।
মানুষ অভাবে ও সংকটে পড়ে। এটি জীবনব্যবস্থার খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তাই কেউ যখন আর্থিক দুরাবস্থায় পড়ে কিংবা গুরুতর প্রয়োজনে বাধ্য হয় তখন অন্যের কাছ থেকে ঋণ নেয়। ঋণের টাকায় নিজের প্রয়োজন ও আবশ্যিকতা পূরণের চেষ্টা করে। কিন্তু ঋণ কারো কারো জীবনে কখনো অভিশাপ বয়ে আনে। ঋণদাতাকে যেমন ঋণ আদায় করতে না পারার হাতাশায় ভুগতে হয় তেমনি ঋণগ্রহীতাকেও ঋণদাতার বাক্যবাণে নাজেহাল হতে হয়। কখনো কখনো অসম্মানজনক আচরণের শিকার হতে হয়। তাই ঋণগ্রহীতা সবসময় কামনা করেন যেন দ্রুত ঋণ পরিশোধ করে দিতে সক্ষম হন। আর ঋণের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন।
মানুষের জীবনে যেমন দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থাকে, অপারগতা ও অলসতা থাকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থাকে তেমনি ঋণের ভার ও দমন-পীড়ন থাকে। বর্তমানে বানের ঢলের মতো বাড়ছে ঋণ। অধিকাংশ মানুষ কোনোনা কোনোভাবে ছোট-বড় ঋণের কবলে জর্জরিত। ঋণের মাত্রার এই তীব্র ভয়াবহতার পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। প্রথমত সামর্থ্যের গন্ডি অতিক্রম করা। ব্যাংকের লোভী অফার নিয়েও অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
বিভিন্ন ইনস্যুরেন্স ও ব্যাংক লিমিটেডের পক্ষ থেকে বেশি ঋণে অল্প সুদ পরিশোধযোগ্য অফার দেয়া হয়। এমন অফারে লোভী হয়ে ঝাঁপ দেয়ার ফলে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হন। অকল্পনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণেও বাড়ছে ঋণের প্রবণতা। ব্যক্তির যতটুকু আয় তার চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আয় বাড়ছে না চাকরিজীবীর। অপরদিকে কৃষিজীবীদের আরও শোচনীয় অবস্থা।
ঋণ একটি অভিশাপ! হোক তা ব্যক্তির জীবনে বা জাতির জীবনে। হাজার বছর ধরে মানুষকে দাসে পরিণত করে রাখার জন্যে শোষকদের অব্যর্থ হাতিয়ার ছিল এই ঋণ। কারণ ঋণ ও কিস্তির চাপ মানুষকে হয় দাসে পরিণত করে, নয়তো সে হয়ে ওঠে দুর্বৃত্ত। এ যুগে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের আরেকটি সুচতুর ফাঁদ হলো ক্রেডিট কার্ড। যা বাকিতে কেনার অভ্যাস করিয়ে একজন মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে ঋণগ্রস্ত করে তোলারই একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া।
সত্য অস্বীকার করা আর ঋণগ্রস্ত হওয়াকে ইসলামে একইরকম পাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। সনাতন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান ধর্মেও ঋণকে একটি জঘন্য পাপাচার রূপে অভিহিত করা হয়েছে এবং ঋণ যে মানুষের জীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তোলে, সেটা বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। ঋণ সর্বযুগেই ব্যবহৃত হয়েছে একজন মানুষ কিংবা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে দাস বানিয়ে রাখার ফাঁদ হিসেবে। ঋণ মানুষের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। ধ্বংস করে তার নৈতিক চরিত্র ও দৃঢ়তাকে। পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে দেখা যায় প্রতিটি জাতি পতনের আগে ঋণ জর্জরিত ছিল। যে পরিবারে একবার ঋণ ঢোকে, সে পরিবারের সুখ-শান্তি নষ্ট হয়ে যায়।
পশ্চিমা ও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে এখন নেমেছে আমাদেরকে ঋণদাসে পরিণত করার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত নিয়ে যার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ক্রেডিট কার্ড। আপনি যেন উপার্জন করার আগেই ব্যয় করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং একসময় নিজের শান্তি, সম্মান, নৈতিকতা ও মনোদৈহিক সুস্থতা হারিয়ে বসেন, কারণ ঋণগ্রস্ত জীবন দাসের জীবন।
মুরগির খামার করেন বেকার যুবক লালন মন্ডল। ব্যবসা ভালোই চলছিল। পরিচিত একজন উদ্বুদ্ধ করল ব্যাংক থেকে ব্যবসা খাতে ঋণ (সিসি লোন) নিতে। ঋণের টাকায় ব্যবসা আরো বড় হলো। কিন্তু আকস্মিক বার্ড ফ্লুর আক্রমণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সময়মতো কিস্তি শোধ করতে না পারায় খামারের জমি সস্তা দামে বিক্রি করে দিতে হলো। ঋণের বাকি অংশ শোধ করতে করতে লালন মন্ডল এখন দেউলিয়া।
বিয়ে উপলক্ষে মোটা অঙ্কের ঋণ নেন নাসির উদ্দীন। দ্রুত ঋণশোধের আশায় বিয়ের খরচের পর বাকি টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু শেয়ার ব্যবসায় ধ্বস নামার পর আরো ঋণের জন্যে দ্বারস্থ হন অন্য ব্যাংকের। ঋণের কিস্তি চালাতে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের কাছে একের পর এক দেনায় জড়িয়ে পড়েন। সংসারের খরচ সামলাতে না পারায় পরিবারে প্রতিদিন জ¦লে অশান্তির আগুন।
ব্রিটেনের বৃহত্তম সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের সমীক্ষা অনুযায়ী, ইংল্যান্ডে প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি মানুষ ঋণের ধকল সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আমেরিকায় বিবাহ-বিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ ঋণ। ঋণকে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানীরা তাই বলছেন,সম্পর্কের ঘাতক। পাশ্চাত্যে ক্রেডিট কার্ডধারী প্রত্যেকের পরিচয় সে একজন ঋণদাস।
আমাদের দেশে নতুন আগ্রাসনের নাম ঋণ। ২০১৫ সালে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন হচ্ছে, The surging consumer market nobody saw coming. .যার মূল বিষয় ছিল, বাংলাদেশে কীভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার অর্থাৎ বাকিতে কেনার অভ্যাসকে জনপ্রিয় করা যায়। বোস্টন গ্রুপের ভাষ্য, ২০২৫ সালে ঢাকার মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান জনগোষ্ঠীর আকার হবে বর্তমানের দ্বিগুণ। রাজশাহী ও বরিশালে তিন গুণ এবং খুলনায় হবে বর্তমানের ছয় গুণ। কেননা ভারত চীন ইন্দোনেশিয়ার মতো উদীয়মান ধনী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে আশাবাদী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। সেইসাথে অধিকাংশ বাংলাদেশি খরচ ও ঋণশোধের ব্যাপারেও সচেতন। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান ক্রেতা-ভোক্তাদের মধ্যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে মাত্র ৬% আর এদের মধ্যে গৃহঋণ নিয়েছে মাত্র ৩%। ২০১৬ সালে বোস্টন গ্রুপের একটি রিপোর্ট হচ্ছে, This is how consumers turn into debt slaves অর্থাৎ কীভাবে ভোক্তারা ঋণদাসে পরিণত হয়। আমাদের এই দাসত্বের প্রসারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ক্ষুদ্রঋণ প্রচলনকারীরা। এরই ফলাফল আমাদের জাতীয় জীবনে নানা ধরনের নৈতিক অবক্ষয়। সমীকরণটা খুব সহজ, একজন ঋণগ্রস্ত মানুষ মিথ্যা বলে আর যে মিথ্যা বলে সে যে-কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে খুব সহজে। ঋণের চাপে সে আর সৎ থাকতে পারে না।
ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, বিলাসী পণ্যসামগ্রী বাকিতে কিনতে অভ্যস্ত করা। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর জন্যে কাউকে ঋণের দ্বারস্থ হতে হয় না। বিলাসী ভোগ্যপণ্য (স্মার্ট টিভি, হোম থিয়েটার, এসি, ওয়াশিং মেশিন, স্মার্ট ডোর সিকিউরিটি সিস্টেম, গেমিং ল্যাপটপ) কেনার সামর্থ্য না থাকলেও ক্রেডিট কার্ডে তা কিনে ফেলা কয়েক মুহূর্তের বিষয়। একটি ওয়াশিং মেশিনের দাম যদি হয় ৫০ হাজার টাকা,আপনার উপার্জন যা-ই হোক, মিনিমাম এমাউন্ট পে-এবল পলিসিতে ৫% সুদে আপনি তা কিনে ফেললেন। এ ঋণ শোধ হতে সময় লাগবে প্রায় ১৮ বছর এবং এই সময়ে আপনাকে শোধ করতে হবে দুই লক্ষাধিক টাকা। বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডের প্রতি তরুণদের তীব্র আকর্ষণ লক্ষণীয়। পকেটে একাধিক ক্রেডিট কার্ড থাকাকে তারা স্ট্যাটাস সিম্বল মনে করে। অথচ এর সাথে দাসত্বের কোনো পার্থক্য নেই।
কিস্তিতে ভোগ্যপণ্য কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে না; বরং এটা নগদে নিজের উপার্জিত টাকায় কিনতে না পারার অযোগ্যতাই প্রকাশ করে। ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারে ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন)-এর ২০০০ সালে দেয়া বক্তব্য হলো যদি ক্রেডিট কার্ডে সুদ আরোপ করার ব্যবস্থা থাকে, সুদ আরোপ হওয়ার আগেই আসল শোধ করে দিলেও এটা অনুমোদনযোগ্য নয়।
সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে ইহলোকে উত্তমর্ণের কাছে সকল ঋণশোধ করার শক্তি দাও। তোমার প্রাসাদে আমায় সকল ঋণ থেকে মুক্ত করো। ঋণ নিমিত্ত নরকপাত থেকে আমায় মুক্ত করো। (অথর্ববেদ : শ্লোক ১১৭-১৮-১৯) বাইবেলে ঋণ নিষিদ্ধ ছিল। সেইন্ট অ্যামব্রোস ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে বলেছেন, সুদি ব্যবসা হলো ঋণী ব্যবসা, যা ডাকাতি এমনকি খুনের সাথে তুলনীয়।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply