অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদী রুদ্ররোষে ধাবিত হচ্ছে। ভারতের উত্তর সিকিমে লোনক হ্রদে বৃষ্টির জেরে দুকূল ছাপিয়ে ছুটেছে তিস্তা। নদীর দুই পাশে যা কিছু আছে, সবই ভেসে যাচ্ছে পানির তোড়ে। প্রবল বেগে ভয়ংকর তিস্তা উজানের পাহাড় থেকে নেমে ভারতের গজলডোবা হয়ে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের সমতলেও প্রবেশ করেছে। বুধবার সকাল ১০টায় ভারতের গজলডোবা থেকে ৮২৫২.৪০ কিউসেক করে প্রতি সেকেন্ডে বেলা ৩টা পর্যন্ত পানি ছাড়া হয় বলে জানানো হয়েছে।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার (৫২.১৫) ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল ও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ৫ জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধায় তিস্তা নদীতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলা, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, তিস্তা ব্যারাজ ডিভিশনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে রয়েছেন। তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন এবং তিস্তা অববাহিকার চর ও সংলগ্ন গ্রামের বসবাসকারী পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছেন।
পানি বৃদ্ধির কারণে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, গয়াবাড়ী, খালিশা চাপানী ও ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রাম এবং জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি, গোলমুন্ডা, শোলমারী ইউনিয়নের চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হওয়ার ফলে প্রায় ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উজানের ঢলে চরের আধাপাকা আমন ধান কেটে ঘরে তুলতে দেখা যায়। বৃষ্টিতে ভিজে চরবাসী এই ধান কাটতে বাধ্য হয়েছে।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে আলম সিদ্দিকী জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকাল থেকেই সতর্কতা জারি করে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে। বন্যাকবলিত দুর্গত এলাকা পরিদর্শনও করেছি।
এদিকে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় লালমনিরহাট জেলার ৫ উপজেলার তিস্তা চরাঞ্চলের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ শুরু করেছে। চরের রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। বন্যার আশঙ্কায় অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করছে।
জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, ফকিরপাড়া ইউপির রমনীগঞ্জ, সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না ইউপির পাটিকাপাড়া, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, কালমাটি, পলাশী ও সদর উপজেলার ফলিমারীর চর, খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, বড়বাড়ি, রাজপুর ও গোকুন্ডা এলাকার মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম আরিফ বলেন, তিস্তাপাড়ে রেড এলার্ট শুনে তিস্তা চরের মানুষদের সরে যেতে বলা হয়েছে। অনেকে বিভিন্ন স্কুল ও উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লোকমান হোসেন তিস্তা ব্যারাজ এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ জানান, তিস্তা নদীতে উজান থেকে হরপা বান ধেয়ে আসছে এমন আগাম খবরে সতর্কাবস্থা গ্রহণ করা হয়। নীলফামারীর কালিগঞ্জ জিরো পয়েন্ট দিয়ে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাই প্রথম ধাক্কা এ জেলার ওপর দিয়ে এসেছে। এ জন্য এলাকায় মাইকিংসহ মানুষকে সতর্ক করে তিস্তা চর ও গ্রাম এলাকা এবং বাঁধে বসবাসকারীরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন জেলার পাটগ্রাম, কালিগঞ্জ, আদিতমারী হাতীবান্ধা ও সদর উপজেলার তিস্তা নদীর চর ও চর গ্রামে বসবাস কৃত পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়।
নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা জানান, ভারতের উত্তর সিকিমে লোনক হ্রদে মেঙভাঙা বৃষ্টির জেরে তিস্তা নদীর পানি প্রবল বেগে ভয়ংকরভাবে ঢল নেমে আসছে। এর ফলে সিকিমের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হরপা বান বলা হচ্ছে এটিকে।
তিনি বলেন, ভারত উজানের জলপাইগুড়ি ও তিস্তা নদীতে লাল সতর্ক জারি করেছে। সেই পানি তিস্তা দিয়ে বাংলাদেশে ধেয়ে আসছে বলে ভারতের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আমাদের জানিয়েছে।
আজ দুপুরের পর সেই পানি প্রবেশ করবে বাংলাদেশে। এ জন্য আমরা সব প্রকার সতর্কাবস্থান নিয়েছি। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাস দিয়ে মানুষজনের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সন্ধ্যা ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।