অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ঢাকার আদালত পাড়া থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিরা কারাগারের ভেতরেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতো। প্রায় ছয় মাস আগে থেকে তারা কারাগারে বসে মোবাইলে বাইরে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই গত ২০ নভেম্বর আদালতপাড়া থেকে দুই জঙ্গিকে পুলিশের চোখে স্প্রে ছিটিয়ে ছিনতাই করে নিয়ে যায় সহযোগীরা। কিছু অসাধু কারারক্ষীর সহযোগিতায় তারা এ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতো বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা। কারাগারে মোবাইল ব্যবহার করার বিষয়ে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, কারাগারে জঙ্গিরা শুধু মোবাইল হাতে পায়নি, তারা নির্বিগ্নে ইন্টারনেট সেবাও পেয়েছে। জঙ্গিরা সব সময় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার নিজেদের মধ্যে যোগাযাগ করে থাকে। কারাগার থেকেও তারা নিজেদের সব সিক্রেট অ্যাপ ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগ রক্ষা করেছে।
জঙ্গিদের নিয়ে কাজ করে পুলিশের বিশেষ ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। কর্মকর্তারা বলছেন, কোনও জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে কয়েক মাস পর্যন্ত লেগে যায়। সেখানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি কারাগারে বসেই বাইরে অবস্থান করা সদস্যদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে অপারেশন চালিয়েছে। এখন অতি সহজে তাদের গ্রেফতার করা যাবে না বলে মনে করে সংস্থা দুটি।
সিটিটিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিরা কারাগারে বসে ছিনতাইয়ের যে পরিকল্পনা সাজিয়েছে, সেটায় সফল তারা। কিন্তু তারা কারাগারে কীভাবে মোবাইল পেলো, সেটা জানার বিষয়। কারাগারে কার মাধ্যমে মোবাইল সংগ্রহ করলো সেটা জানা গেলেও কিছুটা হলেও বোঝা যেত জঙ্গিদের মোটিভ। কারাগারেও জঙ্গিদের নেটওর্য়াক তৈরি করা আছে। তারাই এসব ম্যানেজ করে দেয়। এর বিনিমিয় মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকে মোবাইলসহ বিভিন্ন জিনিস সরবরাহকারীরা।
গত ২০ নভেম্বর দুপুরে পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ আদালত থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) নেতা মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোগীরা। দুই জঙ্গি প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তিআসামি। এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সফলতার কাছাকাছি পৌঁছাতে পাড়েনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের বিষয়ে ওই দিনই পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এছাড়া আরও একটি তদন্ত কমিটি করে পুলিশ সদর দফতর।
দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনার পর ২৩ নভেম্বর মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফিকে (২৪) গ্রেফতার করে সিটিটিসি। বিশেষায়িত এই ইউনিট দাবি করে, জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছে অমি। তারা আরও জানায়, জঙ্গিদের টার্গেট ছিল হাজিরা দিতে আসা ১২ সদস্যদের মধ্যে চার জনকে ছিনিয়ে নেওয়া। এই চার জনের মধ্যে প্রধান টার্গেট ছিল আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে শামস। তবে ওই দিন পালানোর সময় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গির মধ্যে একজন মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান (২৪)। সে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে। আর অপর জন আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব (৩৪)। সে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেটশ্বর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, মোবাইলের মাধ্যমে কারাগার থেকে জঙ্গিরা এতো বড় পরিকল্পনা করলো। কিন্তু মোবাইল সরবরাহকারীদের শনাক্ত করা গেলো না। এটাও একটা বড় বিষয়। সিটিটিসির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে এ বিষয়ে লিখিতভাবে আবেদন করা হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
সিসিটিভির ফুটেজের বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ তারা আদালতপাড়া থেকে মোটরসাইকেলে সটকে পড়লেও কিছুপথ এসে মোটরসাইকেল থেকে নেমে যায়। পরে তারা বাইপথে গন্তব্যে চলে যায়। এক মোটরসাইকেলে তিনজন, আবার তাদের মাথায় হেলমেট নেই এবং হাতে কাটা হ্যান্ডকাফ থাকায় ধরে পড়ে যাওয়া ভয়ে তারা পথে মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোনও হদিস করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, শুধু সিটিটিসি না, কোনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই ছিনতাই হওয়া জঙ্গিদের কোনও খোঁজ জানতে পারেনি। কারাগারের বসে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা এতো সহজে তাদের খোঁজ পাওয়া যাবে হবে মনে হয় না। কিন্তু আমরা রাতদিন এক করে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি তারা যতদিন লুকিয়ে থাকুক না কেন তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে পারবে না।
এরআগে ঢাকার আদালত পাড়া থেকে আনসার আল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনতে র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কাজ করছে। পলাতক এই জঙ্গিদের গ্রেফতারে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও র্যাবসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাজ করছে।
সোমবার (৫ ডিসেম্বর) রাতে কারাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, এই মুহূর্তে আমরা এ বিষয়ে কোনও কথা বলছি না। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের দুটি তদন্ত কমিটির পাশাপাশি স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আমরা সব বিষয় মাথায় নিয়ে তদন্ত করছি। দু-একদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে, পরে সব বলা যাবে।
Leave a Reply