অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ‘চরম একটা ভুল পথকে সঠিক মনে করে সন্তানকে দিয়েছিলাম। আজকে আমার আদরের সন্তান বান্দরবানে পাহাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায়। আমি জানি না আমার সন্তান বেঁচে আছে কি না। জানি না কখনো তাকে আর দেখতে পারবো কি না। এটা আমার মা হিসেবে চরম ব্যর্থতা। শিক্ষিত মেয়ে হয়ে আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি কোনটা সঠিক কোনটা ভুল। আমার কোরআন-হাদিসের দক্ষতা কম ছিল। আমাকে ও আমার রাইয়ানকে ডিমটিভেটেড করা হয়েছে। ভুল পথে নেওয়া হয়েছে।’
জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে এভাবেই অনুশোচনায় কাঁদছিলেন আম্বিয়া সুলতানা এমিলি। শুধু তিনিই যে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন তা নয়, নিজের ১৫ বছর বয়সী ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকে নিয়েছেন সেই পথে। এমিলি ঘরে ফিরে এলেও তার সন্তান এখনো নিখোঁজ। ছেলেকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাংবাদিকদের কাছে আকুতি জানিয়েছেন এই মা।
কান্না করতে করতে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে এমিলি বলেন, আব্বু… তুমি যদি আমার মেসেজ পেয়ে থাকো, তাহলে বলছি তুমি চরম ভুল পথে আছ। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না, বিশৃঙ্খলা করবে না। আমি অনুরোধ করছি তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবে।
বুধবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে এ কথা বলেন এমিলি।
এমিলি মূলত একজন কেবিন ক্রু ছিলেন। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে করেছেন চাকরি। এছাড়া বিমান বাংলাদেশেও খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন। পরিবারসহ থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ভালোই ছিল তাদের জীবন। হঠাৎ করে এমিলির ছেলের গৃহশিক্ষক আল-আমিনের মাধ্যমে তার জীবন পাল্টে যায়। সেই শিক্ষকের মাধ্যমেই এমিলি ও তার ছেলে রাইয়ান নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’তে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।
এমিলি জানান, তার স্বামী ছেলের শোকে অসুস্থ। আত্মীয়-স্বজন সবাই পাগল প্রায়। আট মাস ধরে তারা কেউ ছেলের দেখা পাচ্ছেন না।
র্যাব জানায়, ২০২১ সালের প্রথম দিকে আল-আমিনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগ দেন এমিলি। এরপর ২০২২ সালের মার্চ মাসে গৃহশিক্ষক আল-আমিনের নির্দেশনায় এমিলির ছেলে রাইয়ান হিজরতের নামে বাড়ি ছাড়েন। গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য রাইয়ানকে বান্দরবানে নেওয়া হয়। রাইয়ানকে বান্দরবানে নিয়ে যান রনি নামে এক যুবক। তাকে এরইমধ্যে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
গত মার্চে নারায়ণগঞ্জ থেকে রাইয়ান নিখোঁজ হয় বলে জানায় র্যাব। এ ঘটনায় তার বাবা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু তখনো তিনি স্ত্রী-সন্তানের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানতেন না। পরে র্যাব নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করলে রাইয়ানের তথ্য সামনে আসে। এরপর ৩ নভেম্বর র্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠনটির মহিলা শাখা সম্পর্কে তথ্য পায়। যাতে যুক্ত ছিলেন এমিলি। এরপর ৫ নভেম্বর এমিলিকে উদ্ধার করা হয়।
এমিলি সাংবাদিকদের বলেন, আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করা মেয়ে। ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে চাকরি করেছি। ২০১৩ সালে বিমান বাংলাদেশে খণ্ডকালীন চাকরি করেছি।
‘আমার কাছে জঙ্গিদের গ্রুপ, সংগঠনের নাম, তাদের কর্মকাণ্ড সব কিছু গোপন করা হয়েছিল। একটা ভুল বিষয়কে আমার সামনে কোরআন-হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো হয়েছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমিলি বলেন, রাইয়ান আমার একমাত্র আদরের সন্তান। ও আমার কলিজার টুকরা। মেধাবী ছাত্র, বিনয়ী। বিপথে নেওয়ার জন্য আমার সন্তানের মতো ছেলেদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। যার শিকার হয়েছি আমি।
১৫ মার্চ রাইয়ান ঘর থেকে বেড়িয়েছে জানিয়ে এমিলি বলেন, আল-আমিন আমাদের কোরআন-হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছিলেন যে, প্রস্তুতি নিতে হবে, গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে তৈরি হয়ে থাকতে হবে।
ছেলে রাইয়ান শিশু একাডেমি থেকে পুরস্কার পেয়েছে বলে জানান তার মা। তিনি বলেন, আমাকে বলা হয়েছিল, আমার সন্তানকে প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হবে, ভালো প্রশিক্ষণ। সে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবে, যোগাযোগ করতে পারবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
‘আমি দেশবাসীর উদ্দেশে বলতে চাই, আমি যে ভুল করেছি, আমার বুকটা যেভাবে খালি হয়েছে, সেই একই ভুল যেন কোনো বাবা-মা না করেন। আমি শিক্ষিত মেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার খাওয়া-ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে।’
রাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে মা এমিলি বলেন, তোমার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেছেন। আমি খুব ভয় পেয়েছি, যদি তার কিছু হয়ে যায়। তোমার নানা-নানি সবার অবস্থা খারাপ। তোমার কাক্কু, আত্মীয়-স্বজন সবাই পাগল প্রায়। তুমি তোমার বাবা-মাকে অপমানিত করো না। এই দেশে জন্ম নিয়ে তুমি অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছো।
মা হিসেবে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে এমিলি বলেন, আমি শিক্ষিত মা হিসেবে অনুরোধ করছি, বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে সময় দেবেন, বুকে জড়িয়ে ধরবেন, তাদের ভেতরটা জানার চেষ্টা করবেন। অবহেলা করবেন না। সে ছিটকে যেতে পারে যে কোনো সময়। তখন আমার মতো বুক ভাসিয়ে আর লাভ হবে না।
সন্তানকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে এমিলি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ, আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা পাহাড়ে না খেয়ে কীভাবে আছে। ওরা তো ঘরেই ছিল, মায়ের বুকে ছিল। ওরা ওখানে কীভাবে বাঁচবে। ওরা নিজেও জানে না তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদের ফিরিয়ে আনুন, সুযোগ দিন, ওদের উদ্ধার করুন।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী আব্দুল হাদি সুমন ওরফে জন, আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ এবং রনি মিয়াকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় তিনটি উগ্রবাদী বই, নয়টি লিফলেট এবং দুটি ব্যাগ।
Leave a Reply