অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ২০১৮ সাল। ঢাকার রাস্তায় দুই অসহায় শিশু তার অসুস্থ মাকে নিয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। দেখার যেন কেউ নেই। তাদের হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে যাবতীয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন এক তরুণ। সেই বিষয়টা তিনি তার সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে শেয়ার করার পর সারাদেশ থেকে বেশ প্রশংসা পান।
শুধু তাই নয়, সেই পরিবারের যেন আর ভিক্ষাবৃত্তি না করা লাগে, রাস্তায় না থাকা লাগে তার জন্য কুড়িগ্রামের স্থানীয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে নতুন বাড়ি, পরিবারের তিনটি বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করানোসহ যাবতীয় বিষয়টি সুন্দর করে সমাধান করে দেন এই যুবক। যিনি মানবতার সেবক পারভেজ হাসান নামে পরিচিত।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবার পরিচিত মুখ পারভেজ হাসান। নিজের স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই পরিচিতি গড়ে তুলেছেন। আমরা যাদের পথশিশু বলে তাড়িয়ে দেই, সেই পথশিশুদের দেখলেই কাছে টেনে নেন তিনি। রাস্তায় কোনো বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে অসহায় অবস্থায় দেখলে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত যেকোনো মানুষের জন্যই কাজ করছেন পারভেজ।
ছোটবেলা থেকে ভাবনা ছিল অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার, কিন্তু তখন ব্যক্তিগত সচ্ছলতা না থাকায় সম্ভব হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন তখন থেকে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরো অসংখ্য তরুণ। তাদের এই সেবা দেওয়ার দৃশ্যটি ভিডিও ধারণ করে অনুপ্রাণিত করে তুলছেন অন্যদেরও।
পারভেজ হাসান জানান, সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন সত্যিকারের অর্থে অসহায় মানুষের উপকারে কাজ করে যাচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের হাসিমুখ আর কষ্ট লাঘবের গল্প তুলে ধরছে, যেন আগামী প্রজন্মের ভেতর মানবিক গুণগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশে ৩১টি এতিমখানায় এতিম বাচ্চাদের দেখাশোনা করা হয়।
তাদের মাসিক খাবার চালডাল অন্যান্য চাহিদা পূরণ করা হয়। তাছাড়া ‘আমাদের কর্মেই হোক দিন বদল’ এই প্রজেক্টের মাধ্যমে হতদরিদ্র অসহায় পরিবারের প্রধান আয়ের ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করা হয়। তাদের আয়ের মাধ্যম যেমন- নারীদের সেলাই মেশিন, পুরুষদের জন্য রিকশা ভ্যান, কাচামালের ব্যাবসাসহ বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করি তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে।
তিনি জানান, দেশের যেকোন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে আমরা আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কাজ করি। যেমন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান থেকে শুরু করে করোনাভাইরাসের মতো কঠিন মুহূর্তে, অসুস্থ রোগীদের জন্য অক্সিজেন সেবা, লকডাউনে আটকেপড়া মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, নগদ অর্থ প্রদানসহ নানান কাজের মাধ্যমে অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছিলাম। এছাড়া সিলেটের বন্যায় আমরা শুরু থেকেই বিশুদ্ধ পানি, রান্না করা খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার, নগদ অর্থসহ নানান মানবিক কাজ করেছি অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও।
পারভেজ হাসানের প্রায় ১ মিলিয়ন ফলোয়ারের একটি ফেসবুক পেজ আছে। যেখানে নিয়মিত তিনি মানবিক কাজগুলোর ভিডিও শেয়ার করে থাকেন। সেগুলো দেখে প্রশংসা করেন লাখ লাখ মানুষ। ভিডিও ধারণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে পারভেজ জানান, ভিডিও ধারণ করা আমি শুরু করি ২০২১ সালের শুরু থেকে, আগে অবশ্য ভিডিও করতাম না। কাউকে সহযোগিতা করলে ছবি শেয়ার করে আমার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে তাদের স্টোরি লিখে সবাইকে জানাতাম। যেহেতু এই মানবিক কাজগুলো দীর্ঘদিন ধরে করছিলাম, তাই সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী যারা আমাকে অনুপ্রেরণা দিত তাদের আবদার ছিলো ফেসবুকে যাতে পেজ খুলে ভিডিও আপলোড দেই। সেই থেকেই ভিডিও করা।
তবে ভিডিও করলেও আমি কোনো গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করি না। ফোনে ধারণ করি এবং যার ভিডিও করা হচ্ছে তার অনুমতি নিয়েই করি। কারণ দিনশেষে আমার উদ্দেশ্য থাকে ভুক্তভোগী অসহায় মানুষটিকে সত্যিকার অর্থেই উপকার করা, যাতে তার সম্মানহানি না হয়। আর ভিডিওর মাঝে সামাজিক কোনো ম্যাসেজ থাকলে তবেই আপলোড করি। আবার অনেক মানুষকেই সহযোগিতা করি কিন্তু তাদের ভিডিও আপলোড করা হয়না।
সম্প্রতি পারভেজ হাসানের এক ভিডিওতে দেখা যায়, ১১ বছর বয়সী পথশিশু সুজন রাস্তায় ভিক্ষা করে। যার মা নেই, অন্যদিকে বাবা থেকেও নেই। মানুষের অবহেলায় বেড়ে উঠা সুজন কখনো বা না খেয়ে দিন যাপন করে। পারভেজ তাকে কিছু টাকা তোলে দেয়। যাতে সুজনের আর ভিক্ষাবৃত্তি না করতে হয়। সে এই টাকা দিয়ে পপকন কিনবে, সেটা যাতে বিক্রি করে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তোলতে পারে।
অন্য এক ভিডিওতে দেখা যায়, ১৩ বছর বয়সী তাজু গভীর রাতে বেলুন বিক্রি করছে। যার বাবা অনেক আগেই তাদের ছেড়ে চলে গেছে। পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধের ওপর। মা-কে সে কোনো কাজ করতে দেয় না। দুইদিন পর বাসা ভাড়া দেওয়া লাগবে। না হয় ঘরে তালা মেরে দিবে মালিকপক্ষ। টাকা ম্যানেজ করতে পারেনি। রাস্তায় পারভেজের সঙ্গে দেখা। তিনি সেই ছেলেটিকে কাছে টেনে নিলেন, দিলেন বাসা ভাড়ার টাকাও।
আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, ১২ বছরের রাকিব, যে কিনা আমড়া বিক্রি করে সংসার চালাই। পড়ালেখা করার ইচ্ছা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি। চলার পথে পারভেজ গাড়ি থামিয়ে তার সাথে কথা বলেন। দুই ভাইয়ের বাবা অনেক আগে তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। পারভেজ সেই ছেলের হাতে হাস-মুরগী কেনার জন্য তিন হাজার টাকা তোলে দেয়। যাতে তার মা সেটা লালনপালন করে কিছুটা স্বাবলম্বী হতে পারে। রাকিব যাতে স্কুলে পড়তে পারে সেজন্য তাকে সকালে স্কুলে যেতে এবং বিকেলে আমড়া বিক্রির পরামর্শ দেন।
পারভেজ হাসান এভাবে অনেক পথশিশুকে করে তুলেছেন স্বাবলম্বী, দিয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। নিয়েছেন পড়ালেখার দায়িত্ব। শুধু তাই নয়, তিনি পথশিশু ছাড়াও রাস্তায় পড়ে থাকা শতশত মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছেন নিঃস্বার্থভাবে। পথশিশুরা তাকে একবার দেখলে দ্বিতীয়বার আর চিনতে ভুল করে না। দৌড়ে এসে পারভেজ ভাই পারভেজ ভাই বলে ডাকতে থাকে। আর এসবে তিনি শান্তি খুঁজে পান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে পারভেজ হাসান বলেন, আমাদের পরিকল্পনা একটু ভিন্ন। যেহেতু আমরা মানবিক কাজগুলো করেছি, সেহেতু এটাকে সামনে আরও ঘুছালো। সেই জন্য নানান মানবিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। সামনে আমরা কয়েকটি মানবিক প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করবো, যা অসহায় মানুষের জন্য দারুণ কিছু বয়ে আনবে। যারা আমাদের দীর্ঘদিন অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসা দিয়ে পাশে ছিলেন, সেইসব শুভাকাঙ্ক্ষীদের পাশে চাই, ইনশাল্লাহ আমরা একদিন মানবিকতার রোল মডেল হবো।
তরুণদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যত পারেন আপনারা মানবিক এবং সোস্যাল কাজগুলোতে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখুন। এতে করে সামাজিক ও মানবিক দায়বদ্ধতা সরাসরি শেখার সুযোগ আছে। তাছাড়া অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটালে আল্লাহও ভীষণ খুশি হয়। হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় বিষয় ভালো কাজের মাধ্যমই আজীবন বেঁচে থাকা যায় মানুষের প্রার্থনাতে। জাগো নিউজের সৌজন্য
Leave a Reply