মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন- “তুমি সেই মহান আল্লাহর উপর ভরসা কর যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই এবং তাঁর প্রশংসা পবিত্রতার সাথে ঘোষণা কর, তিনি তাঁর দাসদের পাপসমূহ জ্ঞাত। (সূরা- ফুরকান ঃ আয়াত- ৫৮)
মহান আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন- “যে ব্যাক্তি মহান আল্লাহর উপর নির্ভর করে, তার জন্য মহান আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা- ত্বালাক ঃ আয়াত-৩)
১. হযরত ইব্নে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- আমার কাছে (স্বপ্নে অথবা ইলহামে) উম্মতদের পেশ করা হল। আমি একজন নবীকে ছোট একটি দলসহ দেখলাম। কয়েকজন নবীকে দুই একজন লোকসহ দেখলাম। আর একজন নবীকে দেখলাম যে, তার সাথে কোন লোক নেই। তখন হঠাৎ করে আমাকে একটি বিরাট দল দেখানো হল। আমি ভাবলাম এরা আমার উম্মত। আমাকে বলা হল, এরা মূসা (আঃ) ও তার উম্মত। তবে আপনি আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমি দেখলাম। সেখানে একটি বিরাট দল। আবার আমাকে তাকিয়ে দেখতে বলা হল, আসমানের অন্যদিকে দেখলাম। সেখানেও একটি বিরাট দল। তারপর আমাকে বলা হল, এসব আপনার উম্মত। আর তাদের ভিতর থেকে ৭০ হাজার লোক বিনা হিসাবে ও বিনা শাস্তিতে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে। হযরত ইব্নে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তারপর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখান হতে উঠে তার হুজরা শরীফে গেলেন।
এসময় সাহাবীগণ (রাঃ) চিন্তা করছিলেন, ঐসব লোকের ব্যাপারে যারা বিনা হিসাবে ও বিনা শাস্তিতে বেহেশ্তে যাবেন। কেহ বললেন, বোধ হয় তারা ঐসব ব্যাক্তি যারা রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সংসর্গ লাভ করেছেন। অন্য কেহ বললেন, তারা বোধ হয় ঐসব ব্যাক্তি যারা ইসলামের অবস্থায় জন্মলাভ করেছেন। আর তারাতো মহান আল্লাহর সাথে শিরক করেননি। এভাবে সাহাবাগণ (রাঃ) বিভিন্ন কথা বলাবলি করছিলেন। এমন সময় রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হযে এসে বললেন, তোমরা কোন ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছ ? তারা তখন রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিষয়টি সম্পর্কে জানালেন। এতে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তারা হচ্ছে ঐসব ব্যাক্তি, যারা তাবীজ-তুমারের কারবার করেনা এবং করায়ও না। আর তারা কোন কিছুকে শুভ ও অশুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করেনা এবং তারা একমাত্র তাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহর ওপরই ভরসা করে। একথা শুনে উক্কাশা ইব্নে মহসিন (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি মহান আল্লাহর কাছে দু’আ করুন যাতে তিনি যেনো আমাকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করেন। তিনি বললেন, তুমি তাদের মধ্যকার একজন। তারপর আর একজন উঠে বললেন, আপনি মহান আল্লাহর কাছে দু’আ করুন যাতে আমাকেও তিনি তাদের মধ্যে গণ্য করেন। তিনি বললেন, উক্কাশা এ ব্যাপারে তোমার উপর বিজয়ী। (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)
২. হযরত ইব্নে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন- হে মহান আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য ইসলাম গ্রহণ অর্থাৎ আত্মসমর্পন করেছি। তোমারই প্রতি ঈমান এনেছি। একমাত্র তোমারই উপর ভরসা করেছি। তোমারই দিকে ধাবিত হয়েছি এবং তোমারই কাছে ফয়সালা প্রার্থী হয়েছি। হে মহান আল্লাহ্ ! আমি তোমার সম্মানের মাধ্যমে আশ্রয় চাই। যাতে তুমি আমাকে গোমরাহ হতে বাঁচাও। তুমি ব্যতীত আর কোন মা’বুদ নেই। তুমি চিরঞ্জীব, তুমি মরবে না। আর জ্বীন ও মানুষ সবাই মরে যাবে। (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)
৩. হযরত ইব্নে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লামকে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হল তখন তিনি বলেছিলেন- “হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকীল” অর্থাৎ হে মহান আল্লাহ্! আপনিই আমার জন্য যথেষ্ট এবং আপনিই হলেন উত্তম কর্মবিধায়ক। আর লোকজন যখন রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সঙ্গীদের বলেছিল যে, মুশরিকরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে তোমরা তাদেরকে ভয় কর। তখন এতে তাদের ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং বলেছে যে, মহান আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মৃবিধায়ক। (বোখারী শরীফ)
৪. হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে নাজ্বদের দিকে কোন এক জায়গায় জিহাদে শরীক ছিলেন। যখন রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে এলেন তখন তিনিও তার সঙ্গে ফিরে এলেন। দুপুরে তাঁরা সবাই এমন এক ময়দানে এসে হাজির হলেন, যেখানে অনেক কাঁটাওয়ালা গাছপালা ছিল। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে নামলেন এবং অন্যান্য লোকজন গাছের ছায়ার সন্ধানে ছড়িয়ে পড়লেন। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বাবলা গাছের ছায়ায় গেলেন এবং তার তলোয়ারখানি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলেন। আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের ডাকতে লাগলেন। সে সময় তাঁর কাছে একজন গ্রাম্য লোক দেখলাম। তিনি বললেন, এই লোকটি আমার ঘুমন্ত অবস্থায় আমার উপর আমার তলোয়ার উঁচু করেছিল। আমি জেগে দেখি তার হাতে আমার উলঙ্গ তলোয়ার। সে আমাকে বলল, তোমাকে এখন আমার হাত হতে কে বাঁচাবে ? আমি তিনবার বললাম-‘মহান আল্লাহ’! রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিটিকে কোন শাস্তি দিলেন না এবং বসে পড়লেন। (বোখারী শরীফ)
৫. হযরত উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যদি তোমরা মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করার হক আদায় করো অর্থাৎ সঠিক তাওয়াক্কুল (ভরসা) কর, তাহলে তিনি পাখীকে রিযিক দেওয়ার মতোই তোমাদেরকে দিতেন। পাখী তো সকালে খালি পেটে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে। (তিরমিযী শরীফ)
৬. হযরত বারা’আ ইবনে আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- হে অমুক! যখন তুমি তোমার বিছানায় শয়ন করতে যাও তখন তুমি বল- হে মহান আল্লাহ্! আমি নিজেকে তোমার কাছে সমর্পন করে দিয়েছি। আমি আমার চেহারাকে তোমার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি। আমার ব্যাপারটা তোমার কাছে সোপর্দ করেছি। আমার পিঠখানা তোমার দিকে লাগিয়ে দিয়েছি। আর এসব কিছু তোমার শাস্তির ভয়ে এবং তোমার পুরষ্কারের আশায় করেছি। তুমি ব্যাতীত বাঁচার কোন স্থান নেই। আমি তোমার কিতাবের ওপর ঈমান এনেছি যা তুমি নাযিল করেছ এবং তোমার নবীর প্রতিও ঈমান এনেছি। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি তুমি ঐ রাতেই মারা যাও, তাহলে ইসলামের অবস্থায় তোমার মৃত্যু হবে। আর যদি সকালে জীবিত থাক, তাহলে কল্যাণ লাভ করবে। (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)
৭. হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে মদীনা শরীফে হিজরতের সময় সাওর পাহাড়ের গুহায় থাকা অবস্থায় মুশরিকদের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আর তারা তখন আমাদের মাথার উপরে ছিল। তখন আমি বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! যদি এখন তাদের কেউ তাদের পায়ের নিচ দিয়ে তাকায় তবে আমাদেরকে দেখে ফেলবে। তিনি বললেন, “হে আবু বকর! এমন দু’জন ব্যাক্তি সম্পর্কে তোমার কি ধারণা, যাদের সাথে তৃতীয়জন হচ্ছেন মহান আল্লাহ্। (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)
৮. হযরত উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার বাড়ি হতে বের হতেন তখন বলতেন, মহান আল্লাহর নামে বের হচ্ছি এবং তার উপর ভরসা করছি। হে মহান আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই, যেন আমি পথভ্রষ্ট না হই, অথবা আমাকে পথভ্রষ্ট করা না হয়। আমি যেন কারও উপর যুলুম না করি, অথবা আমার উপর যুলুম না করা হয়। আমি যেন মূর্খতা অবলম্বন না করি অথবা আমি মূর্খতার শিকার না হয়ে যাই। (আবু দাউদ ও তিরমিযী শরীফ)
৯. হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে লোক তার বাড়ি হতে বের হওয়ার সময় বলে- “বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি ওয়া লা- হাওলা ওয়ালা- ক্বুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ” অর্থাৎ মহান আল্লাহর নামে বের হলাম এবং মহান আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আর মহান আল্লাহ্ ব্যতীত কারও কাছ হতে শক্তি পাওয়া যায় না। এরূপ দোয়া করলে তাকে বলা হয় তোমাকে হিদায়াত দেয়া হয়েছে। তোমাকে যথেষ্ট দেয়া হয়েছে এবং তোমার হিফাযতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর শয়তান তার নিকট হতে দুরে চলে যায়। (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী শরীফ)
১০. হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমলে দুই ভাই ছিল। তাদের একজন রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর খেদমতে আসত, আর একজন নিজ পেশায় মগ্ন থাকত। ভাই তার ভাই-এর বিরুদ্ধে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে অভিযোগ করল। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, খুব সম্ভব তোমাকে তারই বরকতে রিযিক দেয়া হচ্ছে। (তিরমিযী শরীফ)
Leave a Reply