চড়া দামের পরও ৩০ লাখ টিকিট বিক্রি করেছে কাতার। বিক্রি হওয়া টিকিটের বেশির ভাগই কিনে নেয় কাতার, সৌদি আরব, মেক্সিকো, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও ভারতের মানুষ। মানবাধিকার কিংবা মদ বিক্রি সব ইস্যুতেই কাতারের সমালোচনায় পশ্চিমারা। কোথাও কোথাও এই বিশ^কাপ বয়কটের ডাকও উঠে। সেখান থেকেই ধারণা করা হয়েছিল কাতার বিশ^কাপের আমেজ কিংবা টিকেট বিক্রিতে পশ্চিমাদের এমন কান্ডের বড় প্রভাব পড়বে। তবে ঘটনা ঘটছে উল্টো। ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে বিশ্বকাপ সম্প্রচারের শীর্ষে উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। ব্রাজিলের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম ইউওএলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশে^র ২২৫টি অঞ্চলের মানুষ টেলিভিশন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কাতার বিশ^কাপ সরাসরি উপভোগ করছেন। ২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ^কাপ দেখেন ২২৩টি অঞ্চলের মানুষ। আর ২০১৮ রাশিয়া বিশ^কাপ দেখা গেছে ২১২টি অঞ্চলে। এবার রেকর্ড ৫০০ কোটি মানুষ কাতার বিশ^কাপ দেখছেন। ইউওএলের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের ৫৬টি করে অঞ্চলে,পুরো আমেরিকার (উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য) ৫০টি, এশিয়ার ৪৩টি ও ওশেনিয়ার ২০টি অঞ্চলে কাতার বিশ^কাপের সম্প্রচারস্বত্ব বিক্রি হয়েছে।
৯২ বছরের যাত্রায় অনেক নতুনের জন্ম দিয়েছে বিশ^কাপ, প্রতি আসরেই সংযোজন হয়েছে নতুন কিছুর। তবে এবার কাতার বিশ^কাপে যেন ‘নতুনের আসর ’ বসেছে। বিশ^কাপের আগের সব আসরই অনুষ্ঠিত হয় জুন-জুলাইয়ে। কাতারের তপ্ত জলবায়ুর কারণেই এবারের আসর শীত মৌসুমে সরিয়ে আনা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ কাতার, যারা বিশ^কাপ আয়োজন করেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, আরববিশে^ও কাতারই প্রথম। এশিয়ায় এটি দ্বিতীয় বিশ^কাপ। প্রথমবার হয় ২০০২ সালে, যৌথভাবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে। বিশ^কাপ আয়োজন নিয়ে কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি বলেছেন, ‘করোনা মহামারির পর গোটা বিশ^কে একত্র করার প্রথম বড় টুর্নামেন্ট কাতার বিশ^কাপ। আরববিশে^র ব্যতিক্রমী এক বিশ^কাপ আয়োজন করতে কাতার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
এবার কাতার বিশ^কাপে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যাডিডাসের তৈরি বল ‘আল রিহলা’। বাংলায় যার অর্থ ‘ভ্রমণ’। চামড়ায় তৈরি বলটিতে আছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। বলের নিখুঁত গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য এর ভেতরে ৫০০ হার্জ আইএমইউ সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। যে তথ্য ব্যবহার করে নিখুঁত সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভিএআর)। বিশ^কাপের ইতিহাসে প্রযুক্তিসম্পন্ন বল ব্যবহার করা হচ্ছে এবারই প্রথম। ২০১৮ সালে বিশ^কাপে ভিএআর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। কাতারে অফসাইডের সিদ্ধান্ত হবে আরও নিখুঁত। চালু হয়েছে সেমিঅটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তি। প্রতিটি স্টেডিয়ামের ছাদের নিচের অংশে ১২টি ট্র্যাকিং ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
ফুটবলারদের পারফরম্যান্সের আরও বিশ্লেষণী ও নিখুঁত তথ্য পেতে সংযোজন করা হয়েছে ডেটা অ্যাপ। ৩২টি দলের প্রত্যেক ফুটবলার ম্যাচের পর নিজের খেলাসম্পর্কিত তথ্যগুলো দেখতে পারবেন। ডেটার মধ্যে থাকবে ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ কোন মুহূর্তে তিনি কেমন খেলেছেন, বল পায়ে কেমন ছিলেন, কতটুকু কী প্রচেষ্টা ছিল।
কার্বন-নিরপেক্ষ বিশ^কাপ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিল কাতারের সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগ্যাসি। এ জন্য যাতায়াতে পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক বাসের ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। ইলেকট্রিক বাসগুলো ৪৪টি মেট্রোলিংক এবং ৪৮টি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট রুটে চালানো হবে। আয়োজক কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য, বিশ^কাপের মাধ্যমে চালু হওয়া পরিবেশবান্ধব যানবাহনব্যবস্থা কাতারের যাতায়াতব্যবস্থায় টেকসই হবে। কাতার বিশ^কাপের স্টেডিয়ামগুলো একটি অপরটির খুবই কাছাকাছি। মাত্র ৫৫ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে আটটি স্টেডিয়ামের অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে এটিই সবচেয়ে ‘আঁটসাঁট’ জায়গার বিশ^কাপ।
এবারই প্রথম ছেলেদের বিশ^কাপে নারী রেফারি ম্যাচ পরিচালনা করছেন। ৬৪টি ম্যাচের জন্য মোট ৩৬ জন প্রধান রেফারির নাম ঘোষণা করে ফিফা। এর মধ্যে নারী আছেন তিনজন। রেফারিং করতে যাওয়া এই রেফারিরা হচ্ছেন জাপানের ইয়োশিমি ইয়ামাশিতা, ফ্রান্সের স্টিফানি ফ্রাপার্ট ও রুয়ান্ডার সালিমা মুকানসাঙ্গা। এ তিনজনের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি থাকছেন ব্রাজিলের নিউজা বেক, মেক্সিকোর কারেন ডিয়াজ মেদিনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথরিন নেসবিত। কাতার বিশ^কাপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে অ্যালকোহল। পান করা যাবে না বিয়ার। ধূমপানেও কড়া নিষেধাজ্ঞা। নারী দর্শকরা খোলামেলা পোশাক পরলে তৎক্ষণাৎ শাস্তির আওতায় আনা হবে। দর্শনীয় স্থান ও সরকারি দপ্তরে গেলেও শরীর ঢাকা পোশাক পরতে হবে। পোশাকের বিষয়ে নজরদারি করতে স্টেডিয়ামের ভেতর ক্যামেরা বসানো হয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিধিনিষেধ। হাতা কাটা টি-শার্ট পরতে পারবেন না তারা। বিতর্কিত কিছু লেখা যাবে না টি-শার্টে। নিয়ম ভঙ্গকারীকে জেল থেকে শুরু করে ২ হাজার ৮০০ ডলার পর্যস্ত জরিমানা গুনতে হবে। ফুটবলের ইতিহাসে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ হিসেবে ৩২টি দেশের ফুটবল খেলোয়াড় সহ ১২ লক্ষেরও বেশি দর্শককে ধারণ করবে কাতার।
বিশ^কাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াতের আয়োজন করে বিশ^কে তাক লাগিয়েছে কাতার। তার পাশাপাশি আরও কিছু ইসলামি বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে কাতার চলমান বিশ^কাপে। ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের’ ২২তম আসরে রোববার (২০ নভেম্বর) জনপ্রিয় হলিউড অভিনেতা মর্গান ফ্রিম্যানের সঙ্গে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াত করেন ঘানিম আল মুফতাহ। পারস্য সাগর উপকূলের ছোট দেশ কাতার। বৃহৎ প্রতিবেশী সৌদি আরব ও ইরানের মাঝখানে বিশ^মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া দায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেকে বিটে হারিয়ে আয়োজক দেশের মর্যাদা আদায় করে দেশটি। অভিযোগ ওঠে রাজপরিবার টাকার বিনিময়ে বিশ্বকাপ আয়োজন বাগিয়ে নিয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করে ফিফা। শেষ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদনে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।
এশিয়া,ইউরোপ বা আফ্রিকায় তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি রয়েছে, নিজ নিজ মূল্যবোধ রয়েছে, তেমনি আরব বিশে^রও। ভারতের বড় বড় শহরগুলোতে গরু হেঁটে বেড়াচ্ছে, ইউরোপের পার্কে পোষা কুকুর থাকছে, আরবে উট’কে প্রিয় পশু হিসেবে সমাদর করা হচ্ছে। প্রত্যেকটা অনুভূতিকে তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ দিয়ে ভাবতে হয়। নৃবিজ্ঞানী আর বি টেইলর বলেছেন,‘প্রতিটি সংস্কৃতির প্রথা ও রীতিনীতিসমূহকে সংস্কৃতির বাস্তবতার নিরিখেই মূল্যায়ন করতে হবে।’ ভিন্ন সংস্কৃতিকে গ্রহণ না করা, শ্রদ্ধা না করা থেকে মূলত জেনোফোবিয়া তৈরি হয়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, প্রথা ও মূল্যবোধের সঙ্গে একে অপরের পরিচয় ঘটানোর জন্য বিশ^ ক্রীড়া আসরগুলোর আয়োজন হয়ে থাকে। ফলে কাতারে টুর্নামেন্ট উদ্বোধন যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতির মতো হবে না এটাই স্বাভাবিক।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চমৎকার উদার আহ্বান রেখেছে কাতার। অনুষ্ঠানের একটি মুহূর্তে মার্কিন অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যান হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিশেষভাবে সক্ষম কাতারের কিশোর তারকা ঘানিম আল মুফতাহ’র দিকে। ঘানিম কাতার বিশ^কাপ ২০২২-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। একজন বিশেষভাবে সক্ষম কিশোরকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে কাতার বিশে^র বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার বার্তা দিয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মরগান ঘানিমকে জিজ্ঞেস করেন ‘আমাদের কাছে যতবেশি একত্র হওয়ার উপাদান তার চেয়ে বেশি আলাদা হওয়ার উপাদান,আমরা কীভাবে সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারি?’ কাতারি কিশোর জবাব দেয়,‘একমাত্র সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা আমাদের এক ছাদের নিচে রাখতে পারে।’
কাতারি কিশোর পবিত্র আল কোরআনের সুরা আল হুজরাতের ১৩ নম্বর আয়াতও পড়ে শোনায়। এই আয়াতটির অর্থ, ‘হে মানুষ আমি তোমাদের সবাইকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’ এই আয়াত মূলত ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ বা ‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’ দর্শনের কথাই বলেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যখন এই বার্তা প্রচারিত হচ্ছিল তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ ও তার পিতা ও কাতারের জাতির জনক শেখ হামাদ বিন থানি। মঞ্চের প্রথম সারিতে উপস্থিত ছিলেন সৌদি যুবরাজ সালমান, জাতিসংঘের মহাসচিব, মিসর, তুরস্ক,আলজেরিয়া ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট। যে সৌদি আরব কাতারকে বিশ^মঞ্চ থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল সে সৌদি আরবের যুবরাজকে পাশে বসিয়ে আঞ্চলিক ও বৈশি^ক সমস্যা মোকাবিলায় সহনশীলতার বার্তা দিয়েছে কাতার।
শুধু ফুটবল আয়োজন নয়, এর আগে থেকেই ধীরে ধীরে বিশে^র বুকে একটি কূটনৈতিক মধ্যস্থতাকারী ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে মাত্র ৩ লাখ জনসংখ্যার কাতার। লেবানন, ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া, লিবিয়া, সুদানসহ বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্যস্থতা করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান শান্তি প্রক্রিয়ার মূল সঞ্চালক ছিল কাতার। এছাড়া ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের আয়োজক ছিল কাতার। বর্তমানে তুরস্ক-সৌদি আরব, ইরান-সৌদি আরব বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে দেশটি। কাতারের এসব মধ্যস্থতার ভূমিকায় সফট পাওয়ার হিসেবে কাজ করছে কাতারের মালিকানাধীন নিউজ মিডিয়া ‘আলজাজিরা’। তেল ও গ্যাসে কাতারের অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠলেও এয়ারলাইনস ও ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবে রয়েছে তাদের বিশাল বিনিয়োগ। রূপকল্প ২০৩০-এর অংশ হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় বিশেষ অবস্থান করে নেয়ার পরিকল্পনা কাতারের। বিশে^র টপ র্যাংকিং বিশ^বিদ্যালয়গুলোর শাখা রয়েছে কাতারে। এখন সেসব বিশ^বিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের ৪২ শতাংশই নারী। এছাড়া ‘কাতার ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে বিশে^র নানা জায়গায় চ্যারিটি করা হচ্ছে। এসবের মূল ভাবনায় আছেন সাবেক আমির শেখ হামাদের স্ত্রী ও বর্তমান আমিরের মা শায়খা মোজাহ।
সৌদি আরবের ব্রিটিশ সেন্টারে স্ট্র্যাটেজিক রাজনীতি বিশ্লেষক আমজাদ তাহা দাবি করেন কাতার ও ইকুয়েডর ম্যাচটি ফিক্সড। ম্যাচে যেন ইকুয়েডর হেরে যায় তার জন্য ইকুয়েডরের চারজন ফুটবলারকে ঘুষ দেয়া হয়। ৯২ বছরের বিশ^কাপ আয়োজনের ইতিহাসে প্রথম স্বাগতিক দেশ হিসেবে হেরে গিয়ে কাতার সে গুজবের জবাব দিয়েছে। এই বিশ^কাপে কাতার খরচ করেছে প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলার। প্রথম ম্যাচে যে ইকুয়েডর কাতারকে হারিয়েছে তাদের জিডিপি মাত্র ১০০ বিলিয়নের কিছু বেশি আর ২৫ শতাংশ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই দারিদ্র্যপীড়িত ইকুয়েডর অনায়াসে হারিয়ে দিল এক বিশ^কাপেই ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলা একটি ধনী দেশকে। এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য। প্রতিবেশী থেকে যখন গুজব রটানো হচ্ছিল তখন কাতারের আমির স্বাগত বক্তব্যে বলছিলেন, ‘বিশ^বাসী আপনাদের কাতারে স্বাগত, আরব বিশে^ স্বাগত।’
কাতারের বিরুদ্ধে স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় শ্রমিকদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমা বিশে^র। এই অভিযোগে বিবিসি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করেনি। কাতার নয় শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। নিউ ইয়র্ক থেকে সিডনি, দোহা থেকে দুবাই বড় বড় ইমারত নির্মাণ হয়েছে শ্রমিকদের ঘামে-রক্তে। শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে পুঁজিপতিদের পুঁজি জ্যামিতিক হারে বেড়েছে এসব দেশে। প্রত্যেক সিভিলাইজেশনের রয়েছে শ্রমিক শোষণ করার নিষ্ঠুর ইতিহাস। মুঘল সাম্রাজ্যের কালজয়ী নিদর্শন তাজমহল নির্মাণেও শ্রমিকদের অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। আবার মুঘল সাম্রাজ্যের মূল্যবান রত্নও লুট করে ব্রিটিশরা। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বহু দেশকে শোষণ-শাসন করেই আজ ইউরোপ-আমেরিকা এত সমৃদ্ধ। ইউক্রেনীয় রিফিউজিদের প্রতি ইউরোপের যে ব্যবহার ছিল সিরিয়ান রিফিউজিদের প্রতি তা ছিল না। আবার ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনীয় শিক্ষার্থীদের ইউরোপের অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিলেও তাদের অ-ইউরোপীয় সহপাঠীদের পাঠানো হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে। কিন্তু ইউরোপীয়দের সেকালের কলোনিয়ালিজমের অপরাধের কারণে এখনকার ইউরোপ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে তা খারিজ করা যায় না। কাতার একটি সুন্দর ও নির্মোহ আয়োজন করেছে বলে তার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের মজুরি ও নির্মাণকাজে নিহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না তা নয়। কাতার ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে পেরেছে কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকদের ইন্স্যুরেন্স কেন দিতে পারবে না, কেন নিহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে না? এই প্রশ্ন থাকতেই পারে।
ফিফার হিসাবে এবার চ্যাম্পিয়ন দল পাবে রেকর্ড ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৩৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা)। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বিশ^কাপের প্রাইজমানি থেকে এবার ৬০ লাখ ডলার বাড়ানো হয়েছে। ২০০৬ বিশ^কাপের সঙ্গে তুলনা করলে প্রাইজমানি বেড়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
ফুটবল একটি শিল্প। ফুটবলের এই উন্মাদনা বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। কারও ব্যক্তিজীবন যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন সংঘাতে না গড়ায়।
এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং তা হতে হবে সহমর্মিতায়।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply